৭ সপ্তম অধ্যায়: সমুদ্র, মেঘ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া
সপ্তম অধ্যায়: সমুদ্র, মেঘ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া
ভূমিকা
প্রাকৃতিক পরিবেশের জটিলতা ও সুষমতা মানব সভ্যতার জন্য এক অপরিহার্য অনুপ্রেরণা। সমুদ্র, মেঘ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো শুধুমাত্র আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ নয়, বরং এগুলোর মধ্যে নিহিত রয়েছে এমন এক অলৌকিক বিন্যাস যা সৃষ্টিকর্তার অসীম জ্ঞান ও পরিকল্পনার প্রমাণ বহন করে। এই অধ্যায়ে আমরা সমুদ্রের স্রোত, গভীর অন্ধকার, মেঘের ভার এবং সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা সম্পর্কিত বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে সেই অলৌকিকতা ও বৈজ্ঞানিক সত্যকে অন্বেষণ করব।
৭.১: মহাসাগরের স্রোত ও গভীর অন্ধকার
- সুরা আন-নূর (২৪:৪০):“অথবা এমন এক অবস্থার মতো, যেন গভীর সমুদ্রের তলে, যেখানে ঢেউ ঢেকে আছে, ঢেউয়ের উপরে ঢেউ, এবং ঢেউয়ের উপরে মেঘ, যা একে অপরকে আচ্ছাদিত করে। সেই লোকের জন্য কোন আলো নেই, যাকে আল্লাহ নুরুদ্দীন করেননি।”(অনুবাদে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে)
আয়াতের ব্যাখ্যা ও প্রেক্ষাপট
এই আয়াতে কোরআন আমাদের সামনে সমুদ্রের গভীর অন্ধকারের একটি চিত্র উপস্থাপন করে। গভীর সমুদ্রের তলে, যেখানে সূর্যালোকের কোন প্রবেশ নেই, সেখানকার অন্ধকার এতটাই ঘন, যে তা এক স্তরের পর অন্য স্তর দ্বারা ঢেকে যায়। এই অবস্থাকে দেখিয়ে, আয়াতটি এমন এক রহস্যময় এবং সুসংহত ব্যবস্থা নির্দেশ করে, যা কেবল আধ্যাত্মিকতারই নয়, বৈজ্ঞানিক সত্যেরও প্রতিফলন।
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
১. গভীর সমুদ্রের অন্ধকার:
- আলোক শোষণ:সমুদ্রের উপরের স্তরে সূর্যালোক প্রবেশ করলেও, জল ধীরে ধীরে সেই আলো শোষণ করে। প্রায় ২০০-৩০০ মিটার গভীরতার পরে সূর্যালোক আর যথেষ্ট না থাকায় পুরো অংশটি অন্ধকারে মগ্ন হয়।
- পরিবেশগত স্তর:গভীর সমুদ্রে বিভিন্ন স্তরে তরঙ্গ, জলচক্র এবং গ্যাসের মিশ্রণে এমন এক অদৃশ্য স্তর সৃষ্টি হয়, যা আকাশে আচ্ছাদিত মেঘের মতোই একে অপরকে ঢেকে রাখে। এই স্তরগুলো একে অপরের সাথে যোগাযোগ রেখে সমগ্র মহাসাগরের স্রোত ও পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে।
২. সমুদ্রের স্রোতের ভূমিকা:
- প্রাকৃতিক পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ:সমুদ্রের স্রোত বিশ্বব্যাপী জলচক্র, তাপ বিনিময় ও জলবায়ুর নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই স্রোত এবং তরঙ্গের গতিশীলতা সমুদ্রের গভীরে এক ধরণের সুষম পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে প্রতিটি স্তর সূর্যের আলো ও তাপকে শোষণ করে।
- জীববৈচিত্র্যের উৎস:গভীর অন্ধকারের এই পরিবেশের মধ্যেও বিশেষ ধরনের জীবাণু ও সামুদ্রিক জীবের আবির্ভাব ঘটে, যা প্রমাণ করে যে, অন্ধকারই কখনোই অসহায় নয়, বরং তা নিজস্ব এক নিয়মিত ও সুসংহত বিন্যাসের অংশ।
কোরআনের অলৌকিকতা ও বৈজ্ঞানিক মিল
কোরআনের এই আয়াতটি ১৪০০ বছরের পূর্বে এমন এক দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছে, যা আজকের আধুনিক মহাসাগরবিদ্যা এবং জলবায়ু বিজ্ঞানের গবেষণায় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। গভীর সমুদ্রের অন্ধকার এবং এর স্তরগুলি বিজ্ঞানীদের দেখিয়েছে যে, প্রকৃতির প্রতিটি স্তরে একটি নির্দিষ্ট নিয়মাবলী ও সুসংহত বিন্যাস রয়েছে। এই মিল আমাদেরকে শেখায় যে, কোরআনের বাণী শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক নির্দেশনা নয়, বরং এটি প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক সত্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে।
মহাসাগরের স্রোত ও গভীর অন্ধকারের এই ব্যাখ্যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সৃষ্টির প্রতিটি উপাদানে সৃষ্টিকর্তার অসীম জ্ঞান ও পরিকল্পনা নিহিত। প্রাকৃতিক পরিবেশের এই গভীরতা ও রহস্য আধুনিক বিজ্ঞান ও কোরআনের বাণীর মধ্যে এক অসামান্য মিল প্রকাশ করে।
৭.২: মহাসাগরের বাধা (Barrier between Seas)
- সুরা আর-রহমান (৫৫:১৯-২০):“তিনি দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেছেন; যখন তারা মিলিত হয়, তারা একে অপরের সাথে মিশে না, বরং তাদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন বিদ্যমান।”(অনুবাদ অনুযায়ী কিছু পার্থক্য থাকতে পারে)
ভূমিকা
কোরআনের এই আয়াত মহাসাগরের দুটি ভিন্ন ধরনের স্রোত বা তরঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান অস্পষ্ট বাধার কথা উল্লেখ করে। আয়াতে বর্ণিত বাধা এমন এক অদৃশ্য সীমার উদাহরণ, যা দুইটি সমুদ্রকে একে অপরের থেকে পৃথক রেখে দেয়, যাতে তারা মিলিত হলেও একে অপরের সাথে পুরোপুরি মিশে না যায়। আধুনিক মহাসাগরবিদ্যা এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে যে, দুইটি বিভিন্ন ধরনের সমুদ্র—যেমন, একটি লবণাক্ত এবং অন্যটি মিষ্টি পানি বা বিভিন্ন তরঙ্গের গতিবেগ ও রাসায়নিক গঠন—একত্রে মিলিত হলেও তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্রতা বজায় থাকে।
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
১. রাসায়নিক এবং পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ
- লবণাক্ততা ও ঘনত্বের পার্থক্য:দুটি সমুদ্র যখন মিলিত হয়, তখন তাদের মধ্যে যদি লবণের পরিমাণ, ঘনত্ব বা অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের পার্থক্য থাকে, তবে একে অপরের সাথে সম্পূর্ণ মিশে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
- প্রবাহ ও তরঙ্গের বৈচিত্র্য:সমুদ্রের প্রবাহ, তরঙ্গের গতিবেগ ও দিকভেদ তাদের পানির গতিশীলতা নির্ধারণ করে। এই পার্থক্যের কারণে দুইটি সমুদ্রের সংস্পর্শেও এক নির্দিষ্ট স্তরের বিভাজন রয়ে যায়।
২. ভূতাত্ত্বিক ও জলবায়ু বিজ্ঞান
- ভৌগোলিক বাধা:কখনও কখনও প্রাকৃতিক ভূগোল যেমন তলদেশ, দ্বীপপুঞ্জ বা সমুদ্রের তলদেশের বৈচিত্র্য দুইটি সমুদ্রকে আলাদা করে রাখে।
- জলবায়ুর প্রভাব:বিভিন্ন জলবায়ু ও তাপমাত্রার পার্থক্যও সমুদ্রের বৈশিষ্ট্য ও প্রবাহের মধ্যে পরিবর্তন এনে দেয়, যার ফলে দুইটি সমুদ্রের মিশ্রণ সীমিত হয়ে যায়।
আধুনিক বিজ্ঞান এবং কোরআনের মিল
সুরা আর-রহমানের এই আয়াতটি প্রাচীন যুগে আবিষ্কৃত হলেও, আজকের বৈজ্ঞানিক গবেষণা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, পৃথিবীর কিছু মহাসাগরীয় সীমান্ত ও বাধা শুধুমাত্র ভৌগোলিক নয়, বরং রাসায়নিক এবং পদার্থবিজ্ঞানের নির্দিষ্ট নিয়মাবলীর ফলাফল।
- সমুদ্রের দ্বৈততা:উদাহরণস্বরূপ, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের মাঝে এমন একটি প্রাকৃতিক বাধা আছে, যেখানে পানির লবণাক্ততা, ঘনত্ব এবং প্রবাহের পার্থক্যের কারণে দুই সমুদ্রের পানি পুরোপুরি মিশে যায় না।
- কোরআনের ইঙ্গিত:এই প্রাকৃতিক নিয়মাবলী কোরআনের আয়াতে প্রতিফলিত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে আল্লাহ তায়া’লা সৃষ্টির প্রতিটি স্তরে একটি সুসংহত এবং নিখুঁত ব্যবস্থা প্রয়োগ করেছেন।
আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
আধুনিক বিজ্ঞান যেমন রাসায়নিক গঠন, প্রবাহ এবং ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের মাধ্যমে এই বাধাটিকে ব্যাখ্যা করে, তেমনি আধ্যাত্মিকভাবে এই আয়াতটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর সৃষ্টি কেবল দৈহিক উপাদান নয়, বরং তার মধ্যে রয়েছে এক গভীর, সুসংহত বিধি ও নিয়মাবলী।
- আধ্যাত্মিক বার্তা:আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, সৃষ্টি এমনভাবে করা হয়েছে যাতে প্রতিটি উপাদান তার নিজস্ব স্বতন্ত্রতা বজায় রাখে, যা মানব জীবনের জন্য একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বার্তা বহন করে।
- বৈজ্ঞানিক বার্তা:সমুদ্রের এই বাধা আমাদেরকে শেখায় যে, প্রকৃতির প্রতিটি স্তরে নিখুঁত নিয়মাবলী ও বৈচিত্র্য বিদ্যমান, যা কেবল একটি দৈব পরিকল্পনারই ফল।
৭.৩: মেঘের ভার ও বৃষ্টিপাত (Heavy Clouds and Rainfall)
- সুরা আর-রূম (৩০:৪৮):“তিনি মেঘকে সংগ্রহ করেন, তারপর তা ভারী করে তুলেন, যাতে তারা তাঁর নির্দেশে বর্ষা নিয়ে আসে।”(অনুবাদে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে)
ভূমিকা
মেঘ মানব সভ্যতার জন্য বর্ষার বার্তা ও পানির উৎস হিসেবে অপরিহার্য। কোরআনের এই আয়াত মেঘের ভার এবং এর মাধ্যমে বৃষ্টিপাত আনার প্রক্রিয়া নিয়ে আল্লাহর সৃষ্টির সূক্ষ্ম নিয়মাবলী তুলে ধরে। আধুনিক জলবায়ু ও আবহাওয়ার বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, মেঘ গঠন, তাদের ভার এবং অবশেষে বৃষ্টির উৎপাদন একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা প্রাকৃতিক বৈজ্ঞানিক নিয়মাবলীর উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। এই আয়াতটি সেই জটিলতা ও সুসংহততা বোঝাতে সহায়ক।
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
১. মেঘের গঠন ও ভার
- মেঘের সৃষ্টি:মেঘ তৈরি হয় যখন বায়ুর আর্দ্রতা (পানির বাষ্প) ঠান্ডা হয়ে কন্ডেন্সেশন (সংগঠিত হওয়া) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছোট ছোট পানি বা বরফের কণায় রূপান্তরিত হয়।
- ভার নির্ধারণ:যখন এই পানি কণাগুলো একত্রিত হয়ে একটি বৃহৎ মেঘ গঠন করে, তখন মেঘের ভার বাড়ে।
- যদিও মেঘের মধ্যে থাকা পানির পরিমাণ অনেক, তা এত ভারী না হওয়ার কারণ, প্রতিটি পানি কণার চারপাশে বায়ু থাকে যা তার আপেক্ষিক ভার কমায়।
- তবু, যখন একটি মেঘের ভার একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছে যায়, তখন তা বৃষ্টিপাত শুরু করে।
২. বৃষ্টিপাতের প্রক্রিয়া
- ভারসাম্য ও চাপ:মেঘে জমাকৃত পানি কণাগুলো, যখন তাদের ভার নির্দিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন বায়ুর চাপ এবং ঠান্ডা তাপমাত্রার কারণে, এই কণাগুলো একসাথে মিলে বিন্দু বিন্দু করে বৃষ্টির ফোঁটা হিসেবে পৃথিবীতে পড়তে শুরু করে।
- জলচক্রের অংশ:এই প্রক্রিয়াটি পৃথিবীর জলচক্রের অপরিহার্য অংশ, যা বায়ুমণ্ডল, সমুদ্র এবং ভূমির মধ্যে পানির প্রবাহ এবং পুনঃবিতরণ নিশ্চিত করে।
৩. আয়াতের ব্যাখ্যা ও আধুনিক বিজ্ঞান
- আল-কোরআনের ইঙ্গিত:সুরা আর-রূমের এই আয়াতে বলা হয়েছে, “তিনি মেঘকে সংগ্রহ করেন, তারপর তা ভারী করে তুলেন, যাতে তারা তাঁর নির্দেশে বর্ষা নিয়ে আসে।”
- এখানে “ভারী করে তোলা” কেবল শারীরিক ভার বৃদ্ধি নয়, বরং এটি মেঘের মধ্যে থাকা পানির পরিমাণের এমন এক সীমা নির্দেশ করে, যার পরে মেঘ নিজে অপরিবর্তনীয় হয়ে বৃষ্টির আকারে পানির মুক্তি দেয়।
- আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:জলবায়ু বিজ্ঞান অনুযায়ী, মেঘের ভার ও বৃষ্টির উৎপাদন একটি নিখুঁত সমন্বয় এবং নিয়ন্ত্রণের ফল।
- মেঘ গঠন, তাদের পরিমাপ, ভার নির্ধারণ এবং বৃষ্টির সময়কাল—এসবই প্রাকৃতিক সূত্রাবলী এবং আবহাওয়ার গতিবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
- এই প্রক্রিয়া এমনভাবে সুসংহত যে, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ ও সময়কাল ভিন্ন হলেও, প্রতিটি অঞ্চলে এটি একটি নির্দিষ্ট নিয়ম এবং সমন্বয় অনুযায়ী ঘটে।
আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক বার্তা
- আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি:কোরআনের এই আয়াত আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ সৃষ্টির প্রতিটি স্তরে নিখুঁত পরিকল্পনা ও নিয়ম প্রয়োগ করেছেন। মেঘের ভার বৃদ্ধি এবং বৃষ্টির অবিরাম ধারা মানব জীবনের জন্য সৃষ্টির এক অপরিহার্য দান, যা আমাদের কৃষি, পানি সরবরাহ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি:আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, মেঘের গঠন ও বৃষ্টির প্রক্রিয়া একটি জটিল, কিন্তু নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক ঘটনা। এটি প্রাকৃতিক বিশ্বে আল্লাহর সৃষ্টির গোপন রহস্যের এক জীবন্ত উদাহরণ।
মেঘের ভার ও বৃষ্টিপাতের প্রক্রিয়া কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, যা আধুনিক জলবায়ু বিজ্ঞানের সাথে অভূতপূর্বভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই মিল আমাদেরকে এক অনন্য দৃষ্টিকোণ প্রদান করে—যেখানে আধ্যাত্মিকতা এবং বিজ্ঞান একে অপরকে পরিপূরক করে মানবজীবনের উন্নতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি অনুপ্রেরণা জোগায়।
৭.৪: সমুদ্রের জোয়ার ও চন্দ্রের প্রভাব
- সুরা আর-রহমান (৫৫:৫-৭):“তিনি সূর্য ও চাঁদ সৃষ্টি করেছেন, প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট কক্ষপথে সাঁতার কাটছে; সূর্য ও চাঁদের চলাচলের মধ্যে এমন সুক্ষ্ম সমন্বয় আছে, যা মানবজীবনের প্রতি নির্দেশিকা প্রদান করে।”(অনুবাদে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে)
ভূমিকা
সমুদ্রের জোয়ার ও ভাঙনের প্রক্রিয়া মানব সভ্যতার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা। কোরআনের সুরা আর-রহমানের এই আয়াত, যা সূর্য ও চাঁদের সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে, আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে এক অসাধারণ অর্থ লাভ করে। সূর্য ও চাঁদের নির্দিষ্ট কক্ষপথ ও মাধ্যাকর্ষণ প্রভাবের মাধ্যমে সমুদ্রের জোয়ার—উচ্চ জোয়ার ও নিম্ন জোয়ার—ঘটিত হয়। এটি প্রমাণ করে যে, সৃষ্টির প্রতিটি উপাদানে এক নিখুঁত ও সুসংহত ব্যবস্থা বিদ্যমান, যা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক দিক থেকেই নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
১. সৌর ও চাঁদের কক্ষপথ ও মাধ্যাকর্ষণ
- নির্দিষ্ট কক্ষপথ:কোরআনের আয়াত অনুযায়ী, সূর্য ও চাঁদ প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট কক্ষপথে চলতে থাকে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে যে, এই গ্রহাণুগুলো একটি স্থায়ী এবং নিয়মিত গতিতে নিজেদের কক্ষপথে আবর্তিত হয়।
- মাধ্যাকর্ষণ প্রভাব:যদিও সূর্যের ভর অনেক বেশি, তবু পৃথিবীর কাছে চাঁদের আপেক্ষিক নিকটত্ব এবং তার মাধ্যাকর্ষণ প্রভাব সমুদ্রের জোয়ারকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ সমুদ্রের পানিকে টেনে নিয়ে যায়, যার ফলে উচ্চ জোয়ার সৃষ্টি হয়।
২. সমুদ্রের জোয়ার-ভাঙনের প্রক্রিয়া
- উচ্চ জোয়ার ও নিম্ন জোয়ার:যখন চাঁদ পৃথিবীর এক পাশে থাকে, তখন তার মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর উক্ত অংশে পানিকে টেনে নিয়ে যায়, যার ফলে উচ্চ জোয়ার হয়। বিপরীত দিক থেকে, পানির পরিমাণ হ্রাস পায় এবং নিম্ন জোয়ার ঘটে।
- সৌর প্রভাব:সূর্যের মাধ্যাকর্ষণও সমুদ্রের জোয়ারকে প্রভাবিত করে, তবে চাঁদের তুলনায় এর প্রভাব কম। সূর্য ও চাঁদের যৌথ মাধ্যাকর্ষণ মিলিত হয়ে, বৎসরভর পরিবর্তনশীল বিভিন্ন ধরনের জোয়ার—যেমন স্প্রিং টাইড (spring tide) ও নিপ টাইড (neap tide)—সৃষ্টি করে।
৩. কোরআনের আয়াত ও আধুনিক বিজ্ঞান
- আয়াতের প্রাসঙ্গিকতা:সুরা আর-রহমানের আয়াতে সূর্য ও চাঁদের নির্দিষ্ট কক্ষপথ এবং চলাচলের কথা বলা হয়েছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানও প্রমাণ করে। এই কক্ষপথের নির্দিষ্টতা ও তাদের মাধ্যাকর্ষণ প্রভাবের ফলস্বরূপ, সমুদ্রের জোয়ার ও নিম্ন জোয়ার একটি নিখুঁত সমন্বয় নিয়ে ঘটে।
- দৈব পরিকল্পনার প্রদর্শনী:এই মিল প্রমাণ করে যে, আল্লাহর সৃষ্টিতে প্রতিটি উপাদান—সৌর, চাঁদ, এবং সমুদ্র—এক অপরের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। সূর্য ও চাঁদের স্থায়ী গতিতে কাজ করে যে জোয়ার-ভাঙন, তা কেবল শারীরিক প্রক্রিয়া নয়; বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক বার্তা বহন করে, যা মানবজাতিকে মনে করিয়ে দেয় সৃষ্টির নিখুঁততা ও সুসংহত নিয়মাবলী।
আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক বার্তা
- আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি:আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি এমনভাবে পরিকল্পিত হয়েছে, যেখানে সূর্য ও চাঁদের চলাচলের নিখুঁততা মানব জীবনের নৈর্ব্যক্তিক ও নৈতিক দিকেও নির্দেশনা দেয়। সমুদ্রের জোয়ার ও নিম্ন জোয়ার আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সৃষ্টিতে প্রত্যেক উপাদানের একটি নির্দিষ্ট স্থান এবং সময় আছে, যা দিক নির্দেশনার সাথে সম্পর্কিত।
- বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি:আধুনিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, সমুদ্রের জোয়ার-ভাঙন প্রক্রিয়া চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ ও সূর্যের প্রভাবের সঠিক সমন্বয়ে ঘটে। এই প্রক্রিয়া, যার ফলাফল মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য, তা কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে এক অসাধারণ নিদর্শন হয়ে ওঠে।
Comments
Post a Comment