৬ ষষ্ঠ অধ্যায়: মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান
ষষ্ঠ অধ্যায়: মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান
ভূমিকা
মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষ মহাকাশের বিস্তৃত সৌন্দর্য এবং এর গঠনমালা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে আসছে। আকাশের নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহ, এবং চন্দ্র-সূর্যের চলাচল থেকে শুরু করে মহাজাগতিক শক্তি, সবকিছুই আমাদের জ্ঞানের সীমাকে প্রসারিত করেছে। আধুনিক বিজ্ঞান মহাবিশ্বের গঠন, প্রকৃতি এবং তার শৃঙ্খলার উপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছে।
তবে, আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে কোরআন যেসব মহাকাশীয় বাস্তবতা সম্পর্কে ইঙ্গিত করেছে, তা আধুনিক গবেষণার সঙ্গে অভাবনীয়ভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই অধ্যায়ে আমরা মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করব এবং কোরআনের আয়াতগুলোর সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সত্যের তুলনা করব।
৬.১ মহাজাগতিক কক্ষপথ (Celestial Orbits)
- সুরা ইয়াসিন (৩৬:৪০):“সূর্য কখনো চন্দ্রকে অতিক্রম করতে পারে না এবং রাতও দিনের আগে আসতে পারে না। প্রত্যেকটি নিজ নিজ কক্ষপথে সাঁতার কাটছে।”
ভূমিকা
এই আয়াতে কোরআন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীরভাবে সূর্য, চন্দ্র এবং মহাজাগতিক বস্তুগুলোর নির্দিষ্ট কক্ষপথে চলাচলের কথা উল্লেখ করেছে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম মৌলিক ধারণাগুলোর মধ্যে এটি একটি, যা প্রমাণ করে প্রতিটি মহাজাগতিক বস্তুর নিজস্ব কক্ষপথ রয়েছে।
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
১. সূর্য ও চন্দ্রের নির্দিষ্ট কক্ষপথ
- বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, সূর্য আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২২০ কিলোমিটার গতিতে তার নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরছে।
- একইভাবে চাঁদ পৃথিবীকে প্রতি ২৭.৩ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে।
২. গ্রহ-উপগ্রহের অবস্থান ও চলাচল
- প্রতিটি গ্রহ তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথ ধরে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে।
- এই কক্ষপথগুলো মহাকর্ষ শক্তি এবং মহাজাগতিক গঠনের মাধ্যমে ব্যালান্স করে।
৩. মহাবিশ্বের শৃঙ্খলা
- কোরআনের “প্রত্যেকটি নিজ নিজ কক্ষপথে সাঁতার কাটছে” কথাটি গ্রহ-নক্ষত্রের চলাচলের গতিশীলতাকে প্রকাশ করে।
কোরআনের অলৌকিকতা
১৪০০ বছর আগে যখন মহাজাগতিক গতিবিধি এবং কক্ষপথের ধারণা মানুষ জানত না, তখন কোরআন এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে, কোরআন শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক গ্রন্থ নয়, বরং বিজ্ঞানের এমন সব সত্য ধারণ করে যা তার সময়ের চেয়েও অনেক অগ্রসর।
সুরা ইয়াসিনের এই আয়াতটি মানব সভ্যতার জ্ঞানচর্চার একটি ভিত্তি স্থাপন করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, কোরআন মহাজাগতিক শৃঙ্খলা এবং গতিবিধির ক্ষেত্রে এমন সব তথ্য প্রকাশ করেছে যা আধুনিক বিজ্ঞান যুগে যুগে আবিষ্কার করছে।
৬.২ মহাকাশ ও সমুদ্রের অন্ধকার: কুরআনের নির্দেশনা ও বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা
ভূমিকা:
মহাকাশের অন্ধকার এবং সমুদ্রের গভীর অন্ধকার উভয়ই প্রাচীনকালের মানুষদের জন্য রহস্যময় ছিল। তবে কুরআন ১৪০০ বছর আগে এই রহস্যময় অন্ধকারের দিকে ইঙ্গিত করে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। এই বিষয়টি বোঝাতে সুরা আন-নূরের (২৪:৪০) একটি আয়াতে সমুদ্রের গভীর অন্ধকারের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে:
“বা [তাদের অবস্থা] গভীর সমুদ্রে অন্ধকারের মতো; একটি ঢেউ অন্য একটি ঢেউকে ঢেকে ফেলেছে, তার উপরে আছে মেঘ। অন্ধকারের স্তরের পর স্তর রয়েছে। যখন সে তার হাত বের করে, তখন সে তা দেখতে পায় না। আল্লাহ যার জন্য আলো নির্ধারণ করেননি, তার জন্য কোনো আলো নেই।”
এই আয়াত কেবল সমুদ্রের অন্ধকারের বাস্তবতা নয়, বরং মহাকাশের গভীরতায় বিরাজমান অন্ধকারেরও দিকে ইঙ্গিত করে। আধুনিক বিজ্ঞান আজ মহাকাশের অন্ধকার এবং এর বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে যা জানিয়েছে, তা কুরআনের এই আয়াতের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সমুদ্রের গভীর অন্ধকার:
আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, সমুদ্রের গভীরে আলো ধীরে ধীরে স্তরে স্তরে বিলীন হয়ে যায়। প্রায় ২০০ মিটার গভীরতার পরে সূর্যালোক আর পৌঁছায় না, এবং সমুদ্রের সেই অংশটি সম্পূর্ণ অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়। এই স্তরগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, সূর্যালোক ৭টি রঙের তরঙ্গে বিভক্ত থাকে, এবং প্রতিটি তরঙ্গ ভিন্নভাবে শোষিত হয়। এই বৈশিষ্ট্যটি কুরআনের আয়াতে উল্লেখিত "অন্ধকারের স্তর পর স্তর" ধারণার সঙ্গে মিলে যায়।
মহাকাশের অন্ধকার:
মহাবিশ্বের অধিকাংশ অংশই অন্ধকারে আচ্ছাদিত। যদিও সূর্যালোক মহাকাশে প্রবেশ করে, তবে তার অনেক অংশ আলোকরশ্মি শোষণ বা ছড়িয়ে পড়ার কারণে অন্ধকার থেকে যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, মহাবিশ্বের প্রায় ৯৬% স্থান অন্ধকার পদার্থ (Dark Matter) এবং অন্ধকার শক্তি (Dark Energy) দ্বারা গঠিত। এই বস্তু ও শক্তি কোনো আলোক কণা বিকিরণ করে না, তাই আমাদের চোখে অদৃশ্য থাকে। এই অন্ধকারের ধারণাটি কুরআনের আয়াতের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে।
ব্ল্যাক হোল ও মহাকাশের গভীর রহস্য:
মহাকাশের একটি অন্ধকার রহস্য হলো ব্ল্যাক হোল। এটি এমন একটি স্থান, যেখানে মহাকর্ষ এত শক্তিশালী যে কোনো আলোর কণাও এর থেকে পালাতে পারে না। ফলে এটি সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে সময় ও স্থান বিকৃত হয়ে যায়, যা আধুনিক বিজ্ঞান দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কার করেছে। এই অন্ধকারময় স্থান কুরআনের নির্দেশিত গভীর অন্ধকারের সাথে সম্পর্কিত বলে প্রতীয়মান হয়।
আলো ও জ্ঞানের ভারসাম্য:
কুরআনের আয়াতগুলো আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ যাকে জ্ঞান এবং সত্যের আলো দেন, সে অন্ধকার থেকে মুক্তি পায়। আর যে অন্ধকারে থেকে যায়, সে আলোর অভাবে বিভ্রান্ত থাকে। এখানে কুরআনের আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক বার্তা একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সুরা আন-নূরের এই আয়াত আধুনিক বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক সত্য উভয়ের দিকেই ইঙ্গিত করে। সমুদ্রের গভীর অন্ধকার এবং মহাকাশের অসীম অন্ধকার সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশনা ১৪০০ বছর আগেই প্রদান করা হয়েছে, যা আজকের বৈজ্ঞানিক গবেষণার সঙ্গে মিলে যায়। এটি আল্লাহর জ্ঞানের অসীমতার নিদর্শন এবং মানবজাতির জন্য মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের একটি চিরন্তন প্রেরণা।
৬.৩ নক্ষত্রের মৃত্যু (Supernova)
- সুরা আন-নাজম (৫৩:১):“শপথ তারকার, যখন তা পতিত হয়।”
ভূমিকা
সুরা আন-নাজমের এই আয়াতে আল্লাহ শপথ করেছেন তারকার পতনের (Fall of the Star) ওপর। প্রাচীনকালে এই আয়াতটি অনেকেই কাব্যিক অর্থে বোঝার চেষ্টা করেছেন, তবে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এর সঙ্গে সুপারনোভার মতো মহাজাগতিক ঘটনাগুলোর মিল পেয়েছে।
সুপারনোভা হলো নক্ষত্রের ধ্বংস বা "মৃত্যু", যা মহাবিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং আলোকময় ঘটনা। এটি এমন এক বিস্ফোরণ, যা একটি নক্ষত্রের জীবনের শেষ পর্যায়ে ঘটে। কোরআনের এই বর্ণনা ও সুপারনোভার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মধ্যে রয়েছে গভীর সম্পর্ক।
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
১. নক্ষত্রের জীবনচক্র
- প্রতিটি নক্ষত্রের একটি নির্দিষ্ট জীবনচক্র থাকে।
- এর শুরু হয় গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ থেকে, যা গ্র্যাভিটেশনাল আকর্ষণের মাধ্যমে একত্রিত হয়ে নক্ষত্রে রূপান্তরিত হয়।
- নক্ষত্রের কেন্দ্রে দীর্ঘ সময় ধরে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটে, যা এর জ্বালানি সরবরাহ করে।
২. নক্ষত্রের পতন বা ধ্বংস
- নক্ষত্র যখন তার সমস্ত জ্বালানি শেষ করে ফেলে, তখন এটি নিজের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কাছে পরাজিত হয়।
- বড় নক্ষত্রগুলো সুপারনোভার মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে যায়। এই বিস্ফোরণের ফলে প্রচুর আলো উৎপন্ন হয়, যা দূরবর্তী স্থান থেকেও দৃশ্যমান।
- বিজ্ঞানীদের মতে, মহাবিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে কোনো না কোনো স্থানে একটি নক্ষত্রের ধ্বংস বা সুপারনোভা ঘটে।
৩. কোরআনের ইঙ্গিত
- সুরা আন-নাজমে "তারকার পতন" শব্দটি এমন এক বাস্তবতাকে চিত্রিত করে, যা সুপারনোভা ঘটনাকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করে।
- আধুনিক বিজ্ঞানের আগে এটি বোঝা অসম্ভব ছিল, কারণ খালি চোখে সুপারনোভা দেখা যায় না।
কোরআনের অলৌকিকতা
কোরআনের এই আয়াতটি নিছক কবিতা নয়, বরং এটি মহাজাগতিক বাস্তবতার ওপর আল্লাহর শপথ। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, তারকারা শুধু স্থির নয়, বরং তারা একটি জীবনচক্র অনুসরণ করে, এবং তাদের "পতন" মহাবিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সুরা আন-নাজমের এই আয়াত এবং নক্ষত্রের পতনের বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। এটি আল্লাহর সৃষ্টির নিখুঁততা এবং কোরআনের ভবিষ্যদর্শী জ্ঞানের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
৬.৪ শবে মেরাজ ও আপেক্ষিকতার তত্ত্ব
ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসে শবে মেরাজ এমন এক অলৌকিক ঘটনা, যেখানে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অতি স্বল্প সময়ে এক অসাধারণ ভ্রমণ সম্পন্ন করেছিলেন। এই যাত্রা মক্কা থেকে জেরুজালেম (মসজিদুল আকসা) এবং সেখান থেকে সপ্তাকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রাচীন কালে এই ঘটনাটি অনেকের জন্য অবিশ্বাস্য মনে হলেও, আধুনিক বিজ্ঞান "আপেক্ষিকতার তত্ত্ব" এবং "সময়ের আপেক্ষিকতা" দিয়ে এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা প্রদান করেছে।
মেরাজের বর্ণনা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ
১. শবে মেরাজের ঘটনা
- মহানবী (সা.)'কে বোরাক নামক এক অলৌকিক বাহনে ভ্রমণ করানো হয়।
- তিনি প্রথম আকাশ থেকে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং বিভিন্ন নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
- এই পুরো ভ্রমণটি এত দ্রুত ঘটে যে, ফিরে আসার পর তাঁর বিছানা তখনো উষ্ণ ছিল।
২. আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (Theory of Relativity)
আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (১৯০৫) বলে যে, সময় স্থির নয়। এটি ভ্রমণের গতি এবং স্থানীয় আকর্ষণের ওপর নির্ভর করে।
গতি ও সময়ের সম্পর্ক
- আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো বস্তু যদি আলোর গতির কাছাকাছি চলতে থাকে, তবে সেই গতির তুলনায় সময় ধীরে চলে।
- বিজ্ঞানীদের মতে, যদি কোনো বস্তু আলোর গতিতে ভ্রমণ করে, তাহলে সময় তার জন্য থমকে যেতে পারে। শবে মেরাজে মহানবীর (সা.)'র সময়ের অনুভূতি এবং পৃথিবীতে সময়ের পার্থক্য এর একটি উদাহরণ হতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট
- শবে মেরাজ ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা, যা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বাইরে।
- তবে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এটি ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে, সময় এবং স্থানের নিয়ম প্রকৃতপক্ষে স্থির নয়।
আল-কোরআনের ইঙ্গিত
১. সুরা বনি ইসরাইল (১৭:১):
“তিনিই মহান, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের এক অংশে ভ্রমণ করালেন পবিত্র মসজিদ থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারপাশে আমি বরকতময় করেছি।”
এই আয়াতটি মেরাজের ঘটনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রকাশ করে।
২. ফেরেশতাদের গতির প্রসঙ্গ
- এখানে সময়ের আপেক্ষিকতা এবং আলোর গতির সঙ্গে ফেরেশতাদের গতির মিল পাওয়া যায়।
শবে মেরাজ একটি অলৌকিক ঘটনা, যা ইসলামের ইতিহাসে এক অসামান্য স্থান দখল করে আছে। এটি আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এবং সময়ের আপেক্ষিকতার মাধ্যমে আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তবে মেরাজের ঘটনাটি শুধুই অলৌকিকতার ওপর ভিত্তি করে, যা মানবিক জ্ঞানের সীমানার বাইরে।
৬.৫ মহাজাগতিক কক্ষপথ (Celestial Orbits)
ভূমিকা
মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহ, উপগ্রহ, তারা এবং ছায়াপথ একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে চলাচল করে। এদের মধ্যে এমন নিখুঁত সমন্বয় রয়েছে, যা গোটা মহাবিশ্বকে এক বিশৃঙ্খল পরিবেশ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এই বিষয়ে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অসংখ্য তথ্য প্রদান করেছে। কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় হলো, ১৪০০ বছর পূর্বে আল-কুরআনে এই মহাজাগতিক কক্ষপথের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল-কোরআনের বাণী
এই আয়াতটি একটি নিখুঁত বৈজ্ঞানিক সত্য প্রকাশ করে, যা আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
১. গ্রহ এবং তারাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথ
আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী, সূর্য, পৃথিবী, চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহ এক নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। এই কক্ষপথের মধ্যে সমন্বয় ব্যাঘাত ঘটলে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
সূর্যের গতি ও কক্ষপথ
- সূর্য নিজেও একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ছায়াপথের কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরছে, যা "Solar Orbit" নামে পরিচিত।
- এর গতি প্রায় ৭২০,০০০ কিমি/ঘণ্টা।
চাঁদের কক্ষপথ
- চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে একটি নির্দিষ্ট উপবৃত্তাকার কক্ষপথে।
- এটি পৃথিবীর জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণ করে এবং জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করে।
২. কক্ষপথের সমন্বয় ও সৃষ্টির সুসংহতি
মহাবিশ্বের এই নিখুঁত সমন্বয় প্রমাণ করে যে, এটি কোনো দৈব ঘটনায় সৃষ্টি হয়নি। বরং এর পেছনে রয়েছে মহান স্রষ্টার প্রজ্ঞা ও শক্তির নিদর্শন।
কোরআনের বৈজ্ঞানিক অগ্রগামিতা
মহাজাগতিক কক্ষপথ সম্পর্কে কোরআনের বর্ণনা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে অভাবনীয়ভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
- ৭ম শতাব্দীতে এই জ্ঞান মানবজাতির কাছে ছিল অকল্পনীয়।
- এটি প্রমাণ করে যে, কোরআন শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা নয়, বরং এটি বিজ্ঞান ও মহাবিশ্বের গভীরতম বিষয়েও আলোকপাত করেছে।
মহাজাগতিক কক্ষপথের এই বিস্ময়কর সমন্বয় মহাবিশ্বের সৃষ্টির অসাধারণ নিয়মাবলী এবং এর স্রষ্টার প্রজ্ঞার প্রতি আমাদের চিন্তাশক্তিকে জাগ্রত করে। কোরআন যে বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার একটি নিখুঁত সমন্বয়, এটি তার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ।
৬.৬ ফেরেশতাদের গমন (সুরা মাআরিজ ৭০:৪) এবং সময়ের আপেক্ষিকতার ধারণা
আধুনিক বিজ্ঞান, বিশেষত আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, সময়ের আপেক্ষিক প্রকৃতি এবং এর সম্পর্ককে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছে। সময় শুধুমাত্র একটি একরৈখিক প্রবাহ নয়; এটি স্থান এবং গতির সাথে সম্পর্কিত এবং এক পরিস্থিতি থেকে অন্য পরিস্থিতিতে পরিবর্তিত হতে পারে। আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মতে, সময়ের গতিবিধি মহাকর্ষীয় শক্তি এবং গতির ওপর নির্ভরশীল।
এদিকে, পবিত্র কোরআনে সুরা মাআরিজ (৭০:৪) এ ফেরেশতাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনের বর্ণনা এসেছে, যা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সময়ের আপেক্ষিকতার ধারণা ও বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত। কোরআনের এই আয়াতে বলা হয়েছে, “ফেরেশতারা ও রুহ (জিব্রাইল) তাঁর কাছে এক দিনে ওঠে, যা তোমাদের মতে পাঁচশত বছর।”
এখানে, কোরআনের ভাষা অনুযায়ী, ফেরেশতারা এক দিনেই হাজার বছরের পথ পাড়ি দেয়। এটা প্রকৃতপক্ষে সময়ের আপেক্ষিকতার একটি অনুরূপ ধারণা। স্থানিক ও সময়গত দৃষ্টিকোণ থেকে সময় ও গতি নির্ধারণের পদ্ধতিতে এমন আপেক্ষিকতা বিদ্যমান যে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছানোর সময়ে ভিন্ন ভিন্ন গতি এবং ক্ষেত্রগত পরিবর্তন ঘটতে পারে।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, অত্যন্ত দ্রুত গতির যাত্রা সময়কে ধীর করে দেয় এবং মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের শক্তি থেকেও সময়ের গতিবিধি পরিবর্তিত হতে পারে। এর মানে, যদি কোন বস্তু বা সত্তা মহাকর্ষীয়ভাবে শক্তিশালী অঞ্চলে থাকে বা দ্রুতগতিতে চলাচল করে, তাহলে তার জন্য সময়ের অভিজ্ঞতা অন্যভাবে হতে পারে। যেমন, পৃথিবী থেকে ছয় মাসের মহাকাশযাত্রার পর ফিরে আসা মহাকাশচারী তাদের অভ্যস্ত সময়ের চেয়ে কম সময় কাটিয়েছে।
এভাবে কোরআনের এই আয়াত আধুনিক বিজ্ঞান ও আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে সময়ের গতিপথ এবং সময়ের অনুভূতি স্থান এবং গতির উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।
এই আলোচনায়, কোরআনের প্রাচীন বাণী এবং আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক এবং মিল দেখা যায়, যা আবার প্রমাণ করে যে ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষাও বৈজ্ঞানিক সত্যের সঙ্গে মিলে যেতে পারে।
Comments
Post a Comment